Guest Post-- by Professor Ipshita Chanda

আল্লাহ্‌র ৯৯টি সুন্দর নাম আছে বলে জানি। তা এই লেখার প্রধান পাত্র যিনি, তাঁর কাজের ফিরিস্তি দিতে গেলে এইরকমই কিছুটা অবাক, কতকটা আশ্চর্য এবং আরো কিছুটা মুখর হওয়া প্রয়োজন। ৮২ বছরের জীবনে নিরন্তর রসাস্বাদন যেমন অন্যতম কাজ ছিল তাঁর, তেমনই আমজনতার সঙ্গে, গোপাল ও রাখাল, দুই ব্র্যান্ডের ছাত্রের সঙ্গে, কনিষ্ঠ ও জ্যেষ্ঠ সহকর্মীদের মধ্যে, সেই রসের পাত্র নিরন্তর ভাগ করে দেওয়া নেওয়াও তাঁর কাজই বলব। 

মানববাবু ছাড়া আফ্রিকার সাহিত্য নিয়ে কলকাতায় তো বটেই, গোটা দেশেই অন্য কোনো পিএইচ ডি সুপারভাইজার পাওয়া যাবেনা বলে আমি যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে গবেষণা করতে আসি। আফ্রিকা সম্পর্কে প্রথম পাঠ তাঁর কাছে এরকম…

আমি (বীরদর্পে): আমি আফ্রিকা নিয়ে কাজ করব।

 তিনি (আলতো করে ) :আফ্রিকা একটা মহাদেশ, গোটাটা নিয়ে কি....

এভাবেই তুলনামূলক সাহিত্য ও আফ্রিকা প্রসঙ্গে আমার বোধোদয় ঘটে।

মানববাবুর পাল্লায় পড়ে আমি বাংলায় লিখতে বাধ্য হই । (প্রসঙ্গত দ্রষ্টব্য , স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত আমার সব পড়াশুনো তৎকালীন বিহারে। তাই মানববাবু বলতেন, আমার বাংলাটা একটু আফ্রিকান) মানববাবু আমায় শিখিয়েছিলেন, “তোমার নাম কী? তোমার নাম কি ঈপ্সিতা?”

মানববাবুর মৃদু উস্কানিতে আমি অন্য ভারতীয় ভাষা ও ভিন দেশী সাহিত্য বাংলায় অনুবাদ করতে আরম্ভ করি।মানববাবুর প্রেরণায় দেশী বিদেশী ভাষা শেখার আজীবন চেষ্টা চালু হয়।
মানববাবুকে দেখে আমি শিখি কীভাবে গবেষক কে নিজের পথ খুঁজে নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়ে পথ যাতে না হারায় সে খেয়াল রাখা যায়, কী ভাবে তার ঊপর কিছুমাত্র না চাপিয়ে তার বোধবুদ্ধির বিকাশ ঘটানো যায়, তার মেধার উপনিবেশীকরন না করেই তাকে মুক্তির উপায় বাতলানো যায় ।
মানববাবুর থেকে পাওয়া শিক্ষকতার পাঠ, আটের দশকের ছাত্র দের কাছে শোনা ~ “গল্প” বলতে বাধছে, কারণ এটা সত্যি ~ কোনো এক পরীক্ষায়, উত্তরে মা ব র ক্লাসে প্রকাশিত মতের ঠিক বিপরীত বক্তব্য লিখেও ২০ তে ১৬ পাওয়া অবাক ছাত্রকে বলেন, যুক্তিসম্মত উত্তর লিখেছো তাই যা পাওয়ার তাই পেয়েছো।

আমি একা নই - মানববাবুর অনেক অনেক ছাত্র, গবেষক, তাঁর কাছ থেকে এইসব অনায়াস শিক্ষা পেয়েছে, জীবনে কার্যকরী করে প্রতিষ্ঠাও কম পায়নি।মানব বাবু সহ অনেকে, আডম্বর বাদ দিয়েই অনেক কিছুকে যাপনের অংশ করে নিয়েছিলেন,তাই আমাদের ও অভ্যাস হয়ে যায়, নারীবাদের আদ্যিকাল থেকে শ্রীমতি বর্জন করে স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে শ্রী লেখা, হাজারো তর্ক সত্তেও ব্যাঙ্ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যত্রতত্র বাংলায় সই, শ্রেণী বিভাগের মুখে ছাই দিয়ে হেড থেকে টেল পর্যন্ত এক টেবিলে আড্ডা ~ সেখানে পডাশুনো প্লাস যাপনরহস্য দুই শিখেছি সমান ভাবে । 

বহু যুগ আগে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছেন , জিজ্ঞেস করলাম, কী করবেন সারা দিন? মানববাবু বললেন – কিছু ভদ্রগোছের বই পড়তে পারি। গ্রাহাম গ্রীনের “মনসিগনর কিহোতে” থেকে আরম্ভ করে হালের করিবিয়ান লেখিকা গ্রেস নিকল্‌স, নতুন ওঠা কাজুয়ো ইশিগুরো, টিমথি মো, সব পড়লেন মানবববাবু। ড: দেব যে কোন লেখকের নাম বলেই বলতেন – “মানব সব পড়েছে”।  

 শুধু পড়েছেন বললে সব কথা বলা হয়না – পড়েওছেন, আমাদের পড়িয়েওছেন। ‘দাঙ্গা ও দেশভাগ’ দু’ভল্যুম, ‘আধুনিক ভারতীয় গল্পের ৫ ভল্যুম, গোটা জুল ভের্ণের অনুবাদ, গোয়েন্দা অম্নিবাস, জীয়নকাঠি, অজস্র লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের অনুবাদ  বাঙ্গালী পাঠক নির্দ্বিধায় বলতেই পারে, “বিপুলা এ পৃথিবীর যতটুকু জানি, তার ৯০ শতাংশ মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিশ্রম, রসবোধ ও দায়িত্ববোধের ফল”। বাংলা ভাষার প্রতি এই নিষ্ঠা, বাঙ্গালী পাঠকের প্রতি এই দায়িত্ব না থাকলে হয়ত বহিরবিশ্ব তাঁকে আরো কিছুটা চিনত – কিন্তু বাইরের পরিচিতি থেকেও ঘরের ভীত-ছাদ-কড়িকাঠ পোক্ত করার দিকে তাঁর মন ছিল বেশী, তাই বাংলায়ই লিখেছেন সিংহ ভাগ, আর শুধু নিজে নয়, আমাদের সকলকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েওছেন, যাতে আমরা বুঝতে পারি এই প্রক্রিয়ার মর্ম, এই দায়িত্বের গুরুভার, এই গ্রহণ-বর্জনের রাজনীতি। 

আমরা কতটা বুঝেছি সেটা তো ক্রমশ প্রকাশ্য, কিন্তু মানববাবু এক মুহুর্তের জন্যও হাল ছাড়েননি। শুনেছি ১৯৭৫ সালে তুলনামূলক সাহিত্যের পাঠক্রমে আধুনিক ভারতীয় ভাষা সাহিত্যের প্রবেশ মানববাবুর তত্বাবধানে। সাল, তারিখ ভুল হতে পারে, তবে এটা সত্যি যে এই ঘটনা ঘটে এবং আজ অবধি সেই ধারা বহাল আছে। গার্সিয়া মার্কেজের নোবেল জয়ের আগেই যে তিনি যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের পাঠ্য হয়ে গেছেন মানববাবুর দৌলতে, সেটা বোধ হয় এখন প্রাচীন অরণ্য প্রবাদের স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছে। সাহিত্য দিয়েই ভেদাভেদ দেখার চোখ তৈরী করেছেন, সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর মন গড়ে দিয়েছেন, রাজনীতির গুপ্ত ও প্রকট পরত খুলে তুলে ধরে নিরন্তর অথচ নিঃশব্দে মানবতাবোধের জয়ঘোষ জারি রেখেছেন মানববাবু। 

হ্যাঁ, তাঁর ক্রিকেট ও টেনিস প্রীতি তাঁর হাতের চিলি কর্ন কানে, সংস্কৃত সাহিত্যের ডিগ্রি – এসব বর্তমান প্রজন্ম জানেনা। 

জানার দরকারই বা কী? বরং যা জানাতে চেয়েছেন, বিবিধতার যে জানালাগুলো নিরন্তর খুলে দিয়েছেন, বহুতার যে পাঠ এত সহজ করে জীবনের মধ্যে, যাপনের মধ্যে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে একটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন আমাদের মধ্যেই – তার থেকে বড় পাওনা, বেশী জানা আর কী হতে পারে? 

অভীক একবার জিজ্ঞেস করেছিল, “স্যার, to whom it may concern-এর বাংলা কী হবে?” মানববাবু তখন দ্বিতীয়বার অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিভাগীয় প্রধান। জনান্তিকে বলি, মানববাবুরই তীক্ষ্ণ বাক্‌ শক্তি একদা বিভাগীয় প্রধান অর্থাৎ বি.প্র.-এর বর্নণা দেয় এভাবে  – অমুক বি.প্র. ও আমরা সকলে বিপ্রদাস। তো সেই বি.প্র. মানববাবুকে অভীক ওই প্রশ্ন করতে তিনি সামনের কাগজপত্র থেকে চোখ না তুলে একদম অভিব্যক্তিহীন গলায় বললেন – “যার মাথা ব্যথা”। মানববাবুর স্বেচ্ছায় মাথাব্যথা বাধানোর ফল, বাংলা সাহিত্য, বাঙ্গালী পাঠক দুহাত ভরে কুড়িয়েছে। 

Postcolonial, postmodern, post হ্যানত্যানের ভীড় দেখে, মানববাবু বলতেন, এরপর বাকি থাকছে শুধু Postman. 

তা আজ থেকে সত্যিই কি আরম্ভ হল বাঙ্গালীর ও তুলনামূলক সাহিত্যের ক্যালেন্ডারে “Post – মানব – ইন্দ্র” era? 

আদৌ না। 

মানববাবু ছিলেন বলা চলেনা, কারণ স্থায়ী ভাবে আছেন। বাংলার পাঠক যতদিন “তৃতীয় বিশ্বের” সাহিত্য পড়বে, যতদিন পূর্ব ইয়োরোপের সাহিত্য পড়বে, যতদিন ডিটেকটিভ গল্প বা কল্পবিজ্ঞানের কাহিনীতে রুচি নেবে, যতদিন রবীন্দ্রনাথ বা সতীনাথে তার শ্রদ্ধা বহাল থাকবে, “মানববাবু থাকবেন”। Post-এ নয়, Present-এ।

Comments

Popular posts from this blog

Remembering Hiroshima, fight nuclear weapons, power and capitalism

Arguments for Proportional Representation

An Open Letter to Tariq Ali