প্রলেতারীয় গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র গঠনের প্রশ্নঃ অক্টোবর বিপ্লবের পর প্রথম পর্ব

 


 

অক্টোবর বিপ্লব সম্পর্কে একটা ধারণা ছড়িয়েছিলেন প্রথমে পরাজিত মেনশেভিক আর দক্ষিণপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারিরা, যা ক্রমে ধরে নেন কাউটস্কি ও অন্য সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা, এবং যেটা ক্রমে সরাসরি দক্ষিণপন্থী প্রচারের সঙ্গে মিশে গেল। সেই ধারণা হল, ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের পর রাশিয়াতে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তৈরী হয়েছিল, এবং লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে তাকে ধ্বংস করেন এবং এক বহু দশকব্যাপী পার্টি একনায়কতন্ত্র কায়েম করেন। মার্কিন একদা কমিউনিস্ট, পরে রক্ষণশীল লেখক ও তাত্ত্বিক সিডনী হুক  কেরেনস্কীর লেখা থেকে ঊদ্ধৃতি সহ বলতে চেয়েছিলেন,  ১৯১৭ থেকে ১৯৮৮ অবধি (যখন তিনি তার প্রবন্ধটি লিখছেন), রাশিয়াতে সবচেয়ে গণতান্ত্রিক নির্বাচন ছিল সংবিধান সভার নির্বাচন, যার জন্য কেরেনস্কী সরকারের আমলে বলশেভিকরা আন্দোলন করেছিলেন, অথচ যার নির্বাচনে তারা যখন ২৫% এর কম ভোট পেলেন, তখন তারা গায়ের জোরে ঐ সভা ভেঙ্গে দিলেন। তিনি এরপর যথারীতি রোজা লুক্সেমবুর্গের রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন।[1]   


লুক্সেমবুর্গের প্রসংগটা গুরুত্ত্বপূর্ণ, কারণ নিজেদের কমিউনিস্ট, লেনিনের থেকে আরো ভাল এবং আসল মার্ক্সপন্থী, এমন দাবী করা তাত্ত্বিকরাও লুক্সেমবুর্গের অসমাপ্ত দ্য রাশিয়ান রেভল্যুশন পুস্তিকার কথা সবসময়েই তোলেন। তাই লুক্সেমবুর্গ সম্পর্কে কিছু কথা বলে রাখা জরুরী। প্রথমত, লুক্সেমবুর্গের এই রচনাতে তিনি বলশেভিকদের সমালোচনা করেছিলেন সহযোদ্ধা বিপ্লবী হিসেবে, প্রতিপক্ষ হিসেবে না। তিনি লিখেছিলেন, বলশেভিকরা গোড়াতে আক্রান্ত, মিথ্যা অপবাদে দুষ্ট এবং চারদিক থেকে শিকার করা হচ্ছে এমন এক সংখ্যালঘু দল থেকে অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিপ্লবী আন্দোলনের শীর্ষে আসতে পেরেছিলেন, এবং তাদের পতাকাতলে জমায়েত করতে পেরেছিলেন সমস্ত প্রকৃত জনগণকে – শহরের শ্রমিক শ্রেণীকে, সৈনিকদের, গ্রামের কৃষকদের, এবং গণতন্ত্রীদের বিপ্লবী অংশ হিসেবে বামপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের।[2]


তাঁর বইয়ের গোড়া থেকে শেষ অবধি, তিনি সমালোচনা রেখেছিলেন ইতিবাচক দিশা থেকে। প্রথম অধ্যায়েই তিনি এক বিকল্প চিন্তা স্পষ্ট করে লিখেছিলেন। “এই পরিস্থিতিতে, বলশেভিক ধারা যে ঐতিহাসিক কাজ করেছে, তা হল, গোড়া থেকেই ঘোষণা করা, এবং লৌহদৃঢ় একনিষ্ঠার সঙ্গে অনুসরণ করা সেই রণকৌশলের, একমাত্র যা পারত গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে এবং বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। সব ক্ষমতা একচ্ছত্রভাবে শ্রমিক ও কৃষক জনতার হাতে, সোভিয়েতদের হাতে –এটাই ছিল বিপ্লব যে সংকটে পড়েছিল তা থেকে বেরোবার রাস্তা …। লেনিনের পার্টিই তাই একমাত্র পার্টি যারা রাশিয়াতে এই প্রথম পর্বে বিপ্লবের প্রকৃত স্বার্থকে বুঝেছিল। … তাই এই দল ছিল একমাত্র দল যারা প্রকৃত সমাজতন্ত্রী নীতি অনুসরণ করেছিল”।[3] এর পর আসে আগের প্যারাগ্রাফে দেওয়া উক্তিটি।


শুধু তাই না। তিনি বইটির শেষে লিখেছিলেন, মৌলিক এবং প্রান্তিকের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। কৌশলের দ্বিতীয় সারির প্রশ্নে নয়, শ্রমিক শ্রেণীর লড়াইয়ের ক্ষমতার প্রশ্নে, ক্ষমতা ও সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে, “লেনিন, ট্রটস্কী ও তাদের বন্ধুরা ছিলেন প্রথম, যারা গোটা পৃথিবীর প্রলেতারিয়েতের কাছে নজির হিসেবে এগিয়ে গিয়েছিলেন, এখন পর্যন্ত কেবল তারাই হুটেনের সঙ্গে রণহুঙ্কার দিতে পারেনঃ আমি সাহস করেছি! এটাই বলশেভিক নীতির যেটা মূলগত ও চিরস্থায়ী”।[4]


এখানেই কিন্তু কাহিনীর শেষ নয়। লুক্সেমবুর্গ বলশেভিকদের যে যে কারণে সমালোচনা করেছিলেন তা সবক্ষেত্রে ভুল, এমন দাবী বর্তমান লেখকের অন্তত নয়। কিন্তু বিশেষ করে সংবিধান সভার প্রসঙ্গ উঠলে, জার্মান বিপ্লবে তাঁর অবস্থান দেখা জরুরী। ১৯১৮-র জার্মান বিপ্লবে, রাশিয়ার মতই দেখা গেল সমাজতন্ত্রী শিবির বিভক্ত। শুধু দক্ষিণপন্থী সমাজতন্ত্রীরা না, দল ভেঙ্গে তৈরী ইউ এস পি বা স্বাধীন সমাজতন্ত্রী দলের নেতারাও জোর দিলেন জাতীয় সভা নির্বাচনের উপর। ‘স্বাধীন’রা অপেক্ষাকৃত বামপন্থী, এবং জঙ্গী শ্রমিকদের এক বড় অংশ তাদের দলেই, ফলে এই দলের বেশ কিছু তাত্ত্বিক প্রস্তাব করলেন, জাতীয় সভা ও শ্রমিক এবং সৈনিক পরিষদ (যেটা জার্মানীতেও হয়েছিল) দুটোই থাকুক। এর বিরুদ্ধে মত দিলেন স্পার্টাকুসবুন্ড, যারা কদিনের মধ্যেই সম্মেলন করে নিজেদের জার্মানীর কমিউনিস্ট পার্টি বলে ঘোষণা করবেন। সদ্য কারামুক্ত লুক্সেমবুর্গ পার্টির মুখপত্র রোটে ফাহন-এ একাধিক প্রবন্ধ লেখেন, যেখানে তিনি জাতীয় সভার বিরোধিতা করেন। ১৭ ডিসেম্বর ১৯১৮ তিনি জাতীয় সভা (বা ভিন্ন অনুবাদে সংবিধান সভা) না পরিষদীয় সরকার? শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, পার্লামেন্টের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র আনা একটা অলীক স্বপ্ন। প্রবন্ধ শেষ হয় এই বলে যে পার্লামেন্ট, সবার সমান ভোট, এ সব মিথ্যা। “শ্রমজীবী মানুষের হাতে পূর্ণ ক্ষমতা, ধনতন্ত্রকে টুকরো টুকরো করার হাতিয়ার হিসেবে – এই হল প্রকৃত সমতা, এই হল  প্রকৃত গণতন্ত্র”।[5]

২৩ ডিসেম্বর আরেকটি প্রবন্ধে তিনি জাতীয় সভাকে চিহ্নিত করেন বিপ্ললবী প্রলেতারিয়েতের বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লবী দুর্গ বলে। তিনি লেখেন, “পরিষদদের হাতে সব ক্ষমতা – এই হবে জাতীয় সভায় আমাদের অংশগ্রহণের চরিত্র”।[6]


অর্থাৎ, দূর থেকে দেখে যা তাঁর কাছে অস্পষ্ট ছিল, এবং যার ফলে একই পুস্তিকায় তিনি দুরকম কথা বলেছিলেন, নিজে বিপ্লবে অংশগ্রহণের ফলে তিনি সেই দ্বিধা কাটিয়ে যে অবস্থান নিলেন, সেটা একেবারেই লেনিন ও ট্রটস্কির মতো।  

শুধু লেনিন ও ট্রটস্কীই এই অবস্থান নেন নি। বামপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা, মারিয়া স্পিরিদোনোভা, লিখেছিলেন যে কিছুকাল আগে অবধি সংবিধান সভাকেই গণতন্ত্রের কেন্দ্র মনে করা হত, কিন্তু এখন আর তা সত্য নয়। জনগণ যখন সোভিয়েতকে নিজেদের সেরা সামাজিক শক্তির কেন্দ্র হিসেবে দেখবেন, তখন সেটাই হবে প্রকৃত জাতীয় সভা।[7]


আর এক বামপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারী সার্গেই মস্টিস্লাভস্কি, লিখেছিলেন যে বলশেভিকদের প্রভাব বাড়ার কারণ, বলশেভিকরা বাস্তবসম্মত শান্তি, এবং শোষকদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার কথা তুলে, বামপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের স্লোগান কেড়ে নিয়েছিলেন।


বামপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারী দলঃ

১৯১৮র মধ্যভাগ থেকে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। তার আলোচনা পরে আসবে। এখানে শুধু বলা দরকার, গৃহযুদ্ধ এবং বিদেশী আক্রমণ, যার মধ্যে সাম্রাজ্যবাদি ফৌজ ছিল, তিন বছর পরে রাশিয়ার রাজনৈতিক চেহারা যেমন বানিয়েছিল, সেটা ১৯১৭-র শেষে ছিল না। তাই এই প্রথম্ম পর্বের ইতিহাস একটু খুঁটিয়ে দেখা দরকার, যাতে যান্ত্রিকভাবে সাম্রাজ্যবাদী বা স্তালিনবাদী, কোনো প্রচার হজম করতে না হয়।

দ্বিতীয় সোভিয়েত কংগ্রেস ক্ষমতা দখল করে দুটি সংগঠন তৈরী করেছিল। একটি হল সারা রাশিয়া সোভিয়েতদের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি, আর অন্যটি হল গণ কমিশার পরিষদ (সভনারকম)। স্বতন্ত্রভাবে কৃষক সোভিয়েতদের কংগ্রেস ডাকা হয়, যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল বামপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের। প্রথমে আমরা স্বতন্ত্রভাবে এই বাম সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের উপরে আলোকপাত করব।

অক্টোবর বিপ্লব হয়েছিল পার্টির নামে নয়, সোভিয়েতের নামে। ক্ষমতা হাতে নেওয়া হোক, এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে করা হয়েছিল সোভিয়েত কংগ্রেসের কাছে। মার্তভ যখন প্রস্তাব করেন যে সব সমাজতন্ত্রী দলদের নিয়ে সরকার গঠন করা হোক, তখন বলশেভিকদের পক্ষে লুনাচারস্কি এই প্রস্তাবে সম্মতি জানান। কিন্তু মধ্যপন্থী ও দক্ষিণপন্থী মেনশেভিকরা, এবং দক্ষিণপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীরা, বলশেভিকদের সঙ্গে একত্রে সরকারে থাকতে রাজি ছিলেন না। এই অবস্থায় মার্তভ নিজেও পিছু হঠে গেলেন। বামপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীরা সোভিয়েত ক্ষমতার পক্ষে ছিলেন, কিন্তু মধ্যস্থতা করার জন্য গোড়ায় সরকারে ছিলেন না। এই কারণে, প্রথম কিছুদিন সভনারকম ছিল নিছক এক বলশেভিক সরকার।  

কিন্তু বামপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীরা সভনারকমে যোগ দিতে রাজি হলেন। তাদের সঙ্গে বাকি সমাজতন্ত্রী দলদের মূল পার্থক্য ছিল, বিপ্লবী সরকার সোভিয়েত কংগ্রেসের অধীনে থাকবে কি না, এই প্রশ্ন। বলশেভিকদের মতো, তারাও মনে করেছিলেন, সরকারকে সোভিয়েতদের অধীনে থাকতে হবে। ১৯১৮-র মার্চ অবধি তারা সরকারে ছিলেন। এই পর্ব নিয়ে ইতিহাসচর্চা হয়েছে তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক কালে, এবং তাও অল্প। সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারী ইতিহাসে বামপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীরা হলেন নড়বড়ে পেটিবুর্জোয়া, যাদের খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই। পাশ্চাত্যে অনেক সময়ে তাদের দেখা হয়েছে সরল, বলশেভিকদের হাতের পুতুল হিসেবে। কিন্তু সিনেলার (১৯৯৭-এর) গবেষণা দেখায়, ১৯১৮-র বসন্তকালে তারা ছিলেন যথেষ্ট শক্তিশালী। মাইকেল মেলাসোঁর গবেষণা দেখিয়েছে, ১৯১৭-১৮তে জঙ্গী রাজনীতি আর বলশেভিকবাদ সমার্থক ছিল না। র‍্যাডিকালবাদ কথাটার অনেক প্রশস্ততর অর্থ ছিল। মেলাসোঁ ইঙ্গিত করেছেন যে বিভিন্ন দলিল দখাচ্ছে, সভনারকম জমি সম্পর্কে যে সব আইন এবং পদ্ধতিগত প্রস্তাব এনেছিল, তাতে বামপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের প্রভাব খুব স্পষ্ট ছিল।[8]

১৫ নভেম্বর বাম সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের মূল দাবী, যে দুই সোভিয়েত কার্যনির্বাহী কমিতির সমতার ভিত্তিতে জোট গড়তে হবে, মেনে নেওয়া হল। দুই কার্যনির্বাহী কমিটি থেকে ১০৮ জন করে প্রতিনিধি থাকবেন, আর থাকবেন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ট্রেদ ইউনিয়ন প্রতিনিধি, এবং স্বতন্ত্রভাব রেল ইউনিয়ন এবং ডাক-তার ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা, এইভাবে সোভিয়েত প্রতিনিধিত্ব প্রশস্ততর করা হল,কিন্তু তার শ্রেণিভিত্তি অক্ষত রেখে।[9]

লেনিন বাম সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের সঙ্গে বলশেভিকদের সহযোগিতা প্রসঙ্গে লেখেন, যদি ভূমি বিষয়ক আইনের ক্ষেত্রে এর ফলে বলশেভিকদের নীতি থেকে সরে যেতে হয়, তাদের উচিত বিরুদ্ধে ভোট না দিয়ে, ভোটদানে বিরত থাকা। তিনি ব্যাখ্যা করেনঃ

“যদি বামপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীরা (এবং তাদের সমর্থক কৃষকরা) [শিল্পের উপর] শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ , ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ, ইত্যাদি মেনে নেয়, তা হলে জমির উপর সমান অধিকার হবে পূর্ণ সমাজতন্ত্রের দিকে উত্তরণের একটি পদক্ষেপ। প্রলেতারিয়েতের দিক থেকে জোর করে উত্তরণের ধাপগুলো চাপিয়ে দেওয়া হবে অবাস্তব। কিন্তু সমাজতন্ত্রের বিজয়ের স্বার্থে,তারা বাধ্য, এই সব উত্তরণের পদক্ষেপ   বাছাইয়ে ছোটো ও শোষিত কৃষকের মত মেনে নেওয়া, কারণ এগুলি সমাজতন্ত্রের কোনো ক্ষতি করবে না”।[10]

 ছ’জন বাম এস আর গণ কমিশারের পদে ছিলেন – কালেগায়েভ (কৃষি), ষ্টাইনবার্গ (ন্যায় দপ্ত্র), প্রোশিয়ান (ডাক ও তার), ত্রুতভস্কি (স্থানীয় স্বশাসন), ইঝমাইলোভিচ (সাধারণতন্ত্রের সম্পত্তি—যদিও তিনি দায়িত্ব নেন নি), ক্যামকভ (সামরিক ও নৌদপ্তরের যুগ্ম কমিশার—পরে ইঝমাইলভিচের দপ্তরও), আল্গাসভ (আভ্যন্তরীণ দপ্তরের কলেজিয়াম)।[11] কীপ, যিনি সোভিয়েত ব্যবস্থাকে মোটামুটি ভাঁওতা হিসেবেই দেখেছেন,এই পদগুলিকেও ভাঁওতা বলতে চান। কিন্তু বাম এস আর রা অন্যান্য দপ্তরেরও কলেজিয়ামে প্রবেশ করেন।এই কলেজিয়াম ব্যবস্থা হল, যে কোনো কমিশারিয়াটে মূল কমিশার ছাড়াও থাকতেন একাধিক সোভিয়েত কার্যনির্বাহী কমিটি সদস্য। সুতরাং, যে কোনো দপ্তরের কাজে, এবং আইন স্থির করার ক্ষেত্রে, এই দল যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল।   

১৯১৭-র ডিসেম্বর থেকে ১৯১৮-র মার্চ পর্যন্ত সভনারকমের ৫৩টি বৈঠক হয়েছিল। বাম এস আর-রা নিয়মিতভাবে এতে এসেছিলেন। শুধু জমির প্রশ্নে নয়, অন্য অনেক প্রশ্নে তারা প্রভাব রেখেছিলেন। যেমন, পূর্ববর্তী যুগের দুই মন্ত্রী, কোকোষ্কিন এবং শিঙ্গারেভকে একদল সৈনিক পিটিয়ে হত্যা করলে পূর্নাঙ্গ তদন্তের ও হত্যাকারীদের শাস্তির যে প্রস্তাব সভনারকম নেয়, তার পিছনে ষ্টাইনবার্গের হাত ছিল। বাম এস আররা জোট সরকার ছেড়ে গেলেন ব্রেষ্ট লিটভস্কের চুক্তির পর, কারণ তারা মনে করেছিলেন, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে কোন সাময়িক রফা নয়, চাই বিপ্লবী যুদ্ধ। তবে, তাদের দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসের বিতর্ক থেকে দেখা যায় যে স্পিরিদনভা সহ বেশ কিছু নেতানেত্রী মনে করেছিলেন, সরকারে ফেরা উচিত।[12]

বলশেভিক সরকার এবং সোভিয়েত গণতন্ত্রঃ

বলশেভিক দল একদলীয় সরকার গঠন করার অর্থ সোভিয়েত গণতন্ত্র নাকচ করা, এই দাবী আদপে গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা দেখেছি, সোভিয়েত কংগ্রেসে বলশেভিকরা বহুদলীয় সরকারের প্রস্তাব মানতে রাজি ছিলেন। সেটা খারিজ হল, কারণ অনেকগুলি সমাজতন্ত্রী দল, যারা বুর্জোয়া ক্যাডেট দলের সঙ্গে জোট সরকার গড়তে এর আগে রাজি হয়েছিল, তারা এখন বলশেভিকদের সঙ্গে, এবং সোভিয়েত কংগ্রেসের কর্তৃত্ব মেনে, সরকার গড়তে রাজি হল না।

বলশেভিকরা এই সময়ে অন্য সমাজতন্ত্রী দলদের উপর কোনোরকম আইনী নিষেধাজ্ঞা জারি করতেও চেষ্টা করেন নি। বরং, যাঁরা সোভিয়েত কংগ্রেস ছেড়ে গেছেন, তাঁদের ফিরে আসার জন্য একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে লেনিন যা লিখেছিলেন, তা থেকেও বোঝা যায়, তিনি একদলীয় ব্যবস্থার কথা ভাবেন নি। তিনি বলেন, সোভিয়েত শাসনে সব ছাপাখানা রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করবে। যথাযথ প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের বন্টন করা হবে। সবার আগে আসবে রাষ্ট্র নিজে, এতদিন বঞ্চিত শ্রমিক, ও বিশেষ করে শত শত বছর অত্যাচারিত কৃষক জনতার স্বার্থে। কিন্তু তিনি লেখেন, এর পরে আসবে বড় দলেরা, ধরা যাক যারা দুটি রাজধানীতে [অর্থাৎ পেত্রোগ্রাদ ও মস্কোতে] এক বা দুই লাখ ভোট পেয়েছে। তার পরে আসবে ছোটো পার্টিরা, এবং তাদের পরে যে কোনো নাগরিক গোষ্ঠী, যারা ন্যুনতম কিছু সদস্য বা সই সংগ্রহ করেছে।[13]

অভ্যুত্থানের চার সপ্তাহ পরে সভনারকমের জন্য লেনিন একটি প্রস্তাবের খসড়া লেখেন, যাতে বলা হয়, কোনো নির্বাচিত সংস্থা বা প্রতিনিধিত্বমূলক সভা প্রকৃতভাবে গণতান্ত্রিক এবং জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক তখনই  হতে পারবে, যখন নির্বাচকদের নির্বাচিতকে ফিরিয়ে আনার অধিকার স্বীকৃত হয় এবং তার অনুশীলন করা হয়।[14]

সারা রাশিয়া সোভিয়েতদের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় এই দলিলের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, এই নীতি থাকলে অভ্যুত্থানের দরকার হত না। উল্লেখযোগ্য, এই বক্তৃতায় তিনি সোভিয়েত রাষ্ট্রকেও দমনের হাতিয়ার বলেন।[15] অর্থাৎ তাঁর চোখে যে কোনো রাষ্ট্রই দমনের হাতিয়ার, তা যত গণতান্ত্রিকই হোক না কেন।

এর পরবর্তী সময়েও, লেভ কামেনেভ সেই সব প্রতিপক্ষদের বিদ্রূপ করেছিলেন, যারা মনে করতেন, বলশেভিকরা আগে থেকেই একদলীয় একনায়কতন্ত্রের কথা ভেবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। তিনি বলেন, চেকা,  স্থায়ী সেনাবাহিনী, রাজনৈতিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ, সবই  রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণী করতে বাধ্য হয়েছে, আত্মরক্ষার জন্য, তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলে।[16]

বলশেভিকরা সর্বদলীয় সরকার না করে একনায়কতন্ত্রের দিকে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, এই দাবী যারা করেন, উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, তারা কিন্তু মনে করেন (এবং করাই স্বাভাবিক) যে পার্লামেন্টারী ব্যবস্থায় কোনো দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তাদের অধিকার আছে একা সরকার গড়ার, এবং আইন পাশ করার।

কিন্তু সংবিধান সভা তো বেশি গণতান্ত্রিক ছিল, আপত্তি ওঠে। সেই সঙ্গে বলা হয়, সংবিধান সভা ভেঙ্গে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে লেনিন গৃহযুদ্ধকে, হিংসা ও স্বৈরতন্ত্রকে, অনিবার্য করে তুলেছিলেন। সংবিধান সভার গণতান্ত্রিকতা সম্পর্কে আর দীর্ঘ বক্তব্য রাখা এখানে যাবে না। লেনিন ও ট্রটস্কী দুজনেই ব্যাখ্যা করেছিলেন, কেন সংবিধান সভা বিপ্লবের অতীতের প্রতিনিধি, বর্তমানের নয়।

কেন তাহলে বলশেভিকরাও সংবিধান সভা নির্বাচনের ডাকে এর আগে সোচ্চার ছিলেন?

অবিভক্ত সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দল তার দ্বিতীয় কংগ্রেসে, ১৯০৩ সালে, নারী ও পুরুষের সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সংবিধান সভার নির্বাচন দাবী করেছিল। ১৯১৭-তেও এই দাবী বলশেভিক কর্মসূচী থেকে বাতিল হয় নি। তার দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, ট্রটস্কী ছাড়া ১৯১৭-র আগে কেউই মনে করেন নি যে রুশ বিপ্লব বুর্জোয়া সীমানা ছাড়িয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, ১৯১৭-তেও যতক্ষণ না সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বাস্তব রূপায়ন হচ্ছে, ততক্ষণ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে সংবিধান সভার দাবী রাখা আবশ্যক ছিল। উপরন্তু, সংবিধান সভাকেও তখন ক্যাডেট, এস. আর এবং মেনশেভিকরা বানচাল করতে চাইছিল। রয় মেদভেদেভ তাঁর দ্য অক্টোবর রেভল্যুশন বইয়ে এস. আর. নেতা বোরিস সকো্লভের স্বীকারোক্তি তুলে ধরেছেন – যে এস. আর. –রা বাস্তবে সংবিধান সভা বসাতে চাইছিল না, আর যে ক্যাডেট দল কর্ণিলভের অভ্যুখানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, তারা তো সংবিধান সভা অবশ্যই চায় নি। সুতরাং, যতক্ষণ না উন্নততর, সোভিয়েত গণতন্ত্র আসছে ততক্ষণ বুর্জোয়া স্বৈরতন্ত্রের প্রতিতুলনায় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিকতার নিদর্শন হিসেবে সংবিধান সভার একটা আপেক্ষিক প্রগতিশীলতা ছিল।

         সংবিধান সভার নির্বাচন হয় ১৯১৭-র নভেম্বর-এ। ফল ঘোষিত হয় ৩০ ডিসেম্বর। ৭০৭ জন প্রতিনিধির মধ্যে দলগত ভাগ ছিল নিম্নরূপ :

মোট প্রতিনিধি                    : ৭০৭

এস. আর                         : ৩৭০

মেনশেভিক                        : ১৬

পপুলার সোশ্যালিস্ট                : ০২

ক্যাডেট                           : ১৭

বলশেভিক                         : ১৭৫

বাম এস. আর                    : ৪০

সংখ্যালঘু জাতি                    : ৮৬

অজ্ঞাত                            : ০১

 

         এই পরিসংখ্যান দিয়ে করা হয়, এস. আর-রা এখানে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পেয়েছিল। কিন্তু এস. আর দলের ইতিহাসবিদ র‍্যাডকি মনে করেন, সংখ্যালঘু ৮৬ জনের একটা বড় অংশ, এবং বিভিন্ন প্রশ্নে এস. আর-দের একাংশ, বলশেভিক-বাম এস. আর জোটের দিকে যেত, ফলে কোনো স্থিতিশীল অবস্থা হত না।[17]

দ্বিতীয়ত, ভোটের ইতিহাস উল্লেখযোগ্য। কোন কোনো এলাকায় ভোট হয়নি। যুদ্ধ এলাকায় সেনাধ্যক্ষরা অস্থায়ী সরকারের পতনের খবর পর্যন্ত লুকিয়ে রেখেছিল। তৃতীয়ত, এস.আর. দের প্রতি যে কৃষক সমর্থন, তার মূলে ছিল, এস. আর –দের পুরোনো কর্মসূচী১৯১৭-তে চের্নভ, আভকসেন্তিয়ভ প্রমুখ সেই কর্মসূচী বর্জন করেছিলেন। পুরোনো কর্মসূচী নিয়ে লড়াই করেছিলেন বামপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীরা। তারাই ছিলেন ব্যাপক কৃষক জনতার কাছে বিপ্লবী বলে পরিচিত। কিন্তু সাংগঠনিক কাঠামোতে তাঁরা ছিলেন দুর্বল। তাই দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের সময়ে তাঁরা বাদ পড়েন। আনুষ্ঠানিকভাবে এস, আর দল ভেঙে তাঁরা আলাদা দল তৈরী করেন ভোটের সামান্য আগে, এবং মাত্র কয়েকটি এলাকায় তাঁরা নিজস্ব প্রার্থী দিতে পেরেছিলেন | কৃষক কংগ্রেসের সঙ্গে সংবিধান সজায় তাঁদের প্রতিনিধির সংখ্যার তারতম্য দেখায় এই ব্যাখ্যা সঠিক | যেখানে স্বতন্ত্র  বাম এস. আর তালিকা ছিল , সেখানে ছবি অন্যরকম |

সারণী – ২

মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা অংশ হিসেব

এলাকা

বাম এস, আর-দের ভোট

দক্ষিণপন্হী এস. আর ভোট

পেত্রোগ্রাদ

কাজান

বাল্টিক নৌবহর

১৬.২

১৮.৯

১৬.৯

০.৫

২.১

১১.৯

 

আরেকটা বিষয়ের উপরও জোর দেওয়া দরকারবুর্জোয়া নির্বাচনী ব্যবস্থায় একজন নাগরিক একা গিয়ে শুধু ভোট দেন সোভিয়েত ব্যবস্থায় শুধু ভোট নয়, স্ব-শাসন চলে তাই যে শ্রমিক বা কৃষক সংবিধানসভায় আপাত নিস্পৃহ, যেখানে নিজে কাজ করছেন, ক্ষমতার অংশীদার হচ্ছেন, সেখানে কিন্তু তিনিই অন্য অবস্থান নিয়েছেন বোরিস সোকোলভ লেখেন যে একটি সৈনিক কংগ্রেসে, এস. আর. – রা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন, কিন্তু ঐ কংগ্রেসেই সোভিয়েত রাজ্যের পক্ষে প্রস্তাবও গৃহীত হয়[18]   

যতক্ষণ না সবচেয়ে উন্নত বুর্জোয়া প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থার চেয়েও গণতান্ত্রিক, প্রলেতারীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতা যাবে, ততক্ষণ বলশেভিকরা, বাম সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারিরা, এবং এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে নৈরাষ্ট্রবাদিরা, সংবিধান সভার আহবান ছাড়েন নি। কিন্তু যেটা মনে রাখতে হবে, ট্রটস্কী ১৯০৫-এর শেষ থেকে, এবং লেনিন এপ্রিল ম্যানিফেস্টোর সময় থেকে, সোভিয়েত ক্ষমতার দাবী তুলেছিলেন।  সঙ্গবিধান সভাভেঙ্গে দেওয়া আর গণতন্ত্র উচ্ছেদ সমার্থক ছিল না, একথা স্বীকার করেছেন বলশেভিক বিরোধী লেখক আলফ্রেড মেয়ার। তিনি লিখেছেন, “এর পরের কয়েকমাস হিংসাত্মক সন্ত্রাস ছিল না। অ-সমাজতন্ত্রী পত্রপত্রিকা বন্ধ করা হয় নি সে বছর গ্রীষ্মকালের  আগে। চেকা তার সন্ত্রাসের রাজত্ব আরম্ভ করে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে এবং লেনিনকে হত্যার চেষ্টার পরে, এবং এই সন্ত্রাসের বিপরীতে আছে বিপ্লবের পরে পরে জারতন্ত্রী জেনারালদের প্রতি সদয় ব্যবহার”।[19]    

ক্ষমতা দখল ও মিশ্র অর্থনীতির দিশাঃ

সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কীভাবে গড়া হবে, তার কোনো তৈরী ছক লেনিনের কাছে, বা কোনো বলশেভিকের কাছেই ছিল না। শ্রমিকশ্রেণীর ডিক্টেটরশিপ বলতে মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, ট্রটস্কী বা লুক্সেমবুর্গ, কেউই মনে করেন নি যে এই ডিক্টেটরশিপের অর্থ একদলীয় শাসন, স্বোইরতন্ত্র, আমলাতান্ত্রিকতা, ইত্যাদি। তেমনি, কেউই মনে করেন নি যে তৈরী ছক থেকে সমাজতন্ত্র গঠন হবে। জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক শ্রমিক দলের খসড়া কর্মসূচির সমালোচনা করতে গিয়ে মার্ক্স লিখেছিলেনঃ ধনতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী সমাজের মধ্যে পড়ে একটির অপরটিতে রূপান্তরিত হওয়ার বৈপ্লবিক পর্ব। এর সঙ্গে সমান্তরালে থাকে একটি রাজনৈতিক উত্তরণ পর্ব, যা প্রলেতারীয়েতের বিপ্লবী ডিক্টেটরশিপ ছাড়া কিছুই হতে পারে না”।[20]

কিন্তু মার্ক্স কেবল এইটুকু বলেন নি। তিনি ওই একই দলিলের অন্যত্র লিখেছিলেনঃ

“এখানে আমাদের যা নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে তা হল একটি সাম্যবাদী সমাজ, যা তার নিজের ভিত্তিভূমিতে গড়ে ওঠেনি, বরং তার বিপরীতে, যা সবে পুজিবাদী সমাজ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। সুতরাং যা সবক্ষেত্রে, অর্থনৈতিকভাবে, নৈতিকভাবে, বৌদ্ধিকভাবে, যে পুরোনো সমাজের গর্ভ থেকে তার উদ্ভব, তারই জন্মদাগে নামাঙ্কিত।  এই কারণে, উৎপাদক সমাজ থেকে ফিরে পায়, [মার্ক্স কর্তৃক আগে উল্লিখিত] বাদসাদের পর, সে যা দিয়েছে সেইটুকুই। সে সমাজকে যা দিয়েছে তা হল তার ব্যক্তিগত শ্রমের নির্দিষ্ট পরিমাণ।  উদাহরণ স্বরূপ, সামাজিক শ্রমদিবস হল ব্যক্তিগত কাজের ঘন্টার সমষ্টি; ব্যক্তি উৎপাদকের শ্রমের সময় হল সামাজিক কর্মদিবসের সেইটুকু যা তিনি দিয়েছেন। তিনি সমাজের কাছ থেকে একটি  সার্টিফিকেট পাবেন যে তিনি এতখানি শ্রম দিয়েছেন ( সাধারণের ফান্ডের জন্য তার শ্রম বাদ দেওয়ার পর) এবং এই সার্টিফিকেটের মাধ্যমে তিনি  ভোগ্যপণ্যের সামাজিক সংগ্রহ থেকে ততটি নেবেন, যতটা ওই পরিমাণ শ্রমের দ্বারা সৃষ্ট। তিনি একভাবে সমাজকে যে শ্রম দিয়েছেন, আরেকভাবে তা ফিরে পাবেন।

স্পষ্টতই এখানে পণ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে যে নীতি চালু, সেটাই খাটবে, যতক্ষণ সমান মূল্যের বিনিময় হচ্ছে। আঙ্গিক ও সারবস্তু পাল্টেছে, কারণ  পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কেউই নিজের শ্রম ছাড়া কিছু দিতে পারবে না, আর ভোগের পদার্থ ছাড়া অন্য কিছুই যেহেতু ব্যক্তি মালিকানায় যেতে পারে না। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে, উতপাদকদের মধ্যে বিনিময়ের নীতি হল পণ্য বিনিময়ের মতই। এক রকমের আঙ্গিকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রম অন্য একটা আঙ্গিকে ঠিক ঐ পরিমাণ শ্রমের সঙ্গেই বিনিময় করা হবে।

সুতরাং সমান অধিকার এখানে এখনও নীতিগতভাবে বুর্জোয়া অধিকার, যদিও এখন নীতি আর অনুশীলন একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নেই, যেখানে পণ্য বিনিময়ে সমতা খাটে কেবল গড়ে, প্রতিটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে না।

এই অগ্রগতি সত্ত্বেও, এই সমান অধিকার ক্রমাগত এক বুর্জোয়া সীমাবদ্ধতায় কলঙ্কিত থাকে। উৎপাদকের অধিকার তারা যতটা শ্রম দেয় তার সঙ্গে আনুপাতিক। এই সমতার ভিত্তি হল, তাকে মাপা হয় এক সমান মাপকাঠি দিয়ে, যা হল শ্রম”।[21]

মার্ক্স ব্যাখ্যা করেছেন, এই ত্রুটিগুলি অনিবার্য, সাম্যবাদী সমাজের প্রথম পর্বে, যখন তা পুঁজিবাদী সমাজ থেকে দীর্ঘ জন্মযন্ত্রণার পর বেরিয়ে এসেছে  (the first phase of communist society as it is when it has just emerged after prolonged birth pangs from capitalist society) , এবং কায়িক ও মানসিক শ্রমের দ্বন্দ্ব, শ্রম বিভাজনের কাছে ব্যক্তির অবনমন, বন্ধ হবে, সাম্যবাদী সমাজের উচ্চতর স্তরে, যেখানে উতপাদিকা শক্তি এমনভাবে বেড়েছে যে তা ব্যক্তির সার্বিক বিকাশের সঙ্গে ঘটে, কেবল তখনই বুর্জোয় অধিকারের সংকীর্ণ সীমারেখা পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।[22]

মার্ক্সের রচনা থেকে এতটা আলোচনা করা দুটি কারণে দরকার। ইতিহাসে এই প্রথম এমন একটা বিপ্লব হয়েছিল, যার নেতারা বিপ্লবের রণনীতি, রণকৌশলের সঙ্গে, বিপ্লবের পর কী হতে পারে তারও একটা অল্প হলেও ধারণা নিয়ে এগোচ্ছিলেন। আর, বলশেভিকদের এক ধরণের সমালোচনা বামপন্থী, মার্ক্সবাদী বলে ঘোষিত শিবির থেকে আসে, যেখানে বলশেভিকরা কেন একলপ্তে ধনতন্ত্র উচ্ছেদ করে সাম্যবাদে চলে যান নি, তাই এই বিপ্লবটাই আসলে ধনতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল, এই ধরণের কথা আসে।[23]

কিন্তু তা হলে কীভাবে সমাজতন্ত্র গঠনের দিকে এগোনো সম্ভব হবে? বস্তুত, লেনিন, ট্রটস্কী, বুখারিন, কেউ মনে করেন নি যে কেবলমাত্র রাশিয়ার মধ্যে সমাজতন্ত্র গড়া সম্ভব। ১৯০৫ সালে, যখন লেনিন রাশিয়াতে একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বেশি কিছু হওয়া সম্ভব না মনে করেছিলেন, তখনও লিখেছিলেনঃ

“প্রলেতারিয়েত ইতিমধ্যেই লড়াই করছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বার্থে গণতান্ত্রিক বিজয়গুলি রক্ষা করতে। এই লড়াই এককভাবে রুশ প্রলেতারিয়েতের কাছে কার্যত অসাধ্য, এবং তাদের পরাজয় হত অনিবার্য … যদি ইউরোপীয় প্রলেতারিয়েত রুশ প্রলেতারিয়েতের সাহায্যে না আসে …। এই স্তরে উদারনৈতিক বুর্জোয়া শ্রেণী এবং স্বচ্ছলরা(এবং মাঝারি চাষীর একাংশ) প্রতিবিপ্লব সংগঠিত করবে।  রুশ প্রলেতারিয়েত এবং ইউরোপীয় প্রলেতারিয়েত বিপ্লব সংগঠিত করবে। এই পরিস্থিতিতে রুশ প্রলেতারিয়েত এক দ্বিতীয় বিজয় পেতেও পারে…। এই দ্বিতীয় বিজয় হবে ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। ইউরোপীয় শ্রমিকরা আমাদের দেখাবেন, ‘ওটা কীভাবে করতে হয়’।”[24]

১৯১৮-র নভেম্বরে সমালোচকদের জবাবে লেনিন বলেনঃ

“যে সব রুশ দেশপ্রেমীরা পুরোনো ভাবে তাদের দেশের আশু স্বার্থ ছাড়া আর কিছুর কথা শুনবে না, ইতিহাসের তথ্য তাদের কাছে প্রমাণ করেছে যে আমদের রুশ বিপ্লবের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে রূপান্তর হঠকারিতা ছিল না, চজিল আবশ্যকতা, কারণ অন্য কোওনো পথ ছিল না। ইঙ্গ-ফরাসী এবং মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ অনিবার্যভাবে রাশিয়ার স্বাধীনতা ও মুক্তির গলা টিপে মারবে, যদি না বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, বিশ্বব্যাপী বলশেভিকবাদ, জয়যুক্ত হয়।”[25]

উদ্ধৃতি বাড়ানো যায়, কিন্তু আমরা এখানে নিছক তাত্ত্বিক আলোচনা করছি না, রুশ বিপ্লবের ইতিহাস দেখছি। এই কথা অন্তত বলাই যায় যে ১৯১৮ সালেও লেনিন তাহলে মনে করছিলেন যে বিশ্ববিপ্লব ছাড়া সোভিয়েত রাশিয়া বেশি দিন বাঁচবে না। এটা শুধু একটা কঠিন সময়ের জন্য তিনি বলেন নি। ১৯২১ সালে, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের তৃতীয় কংগ্রেসের একটি অধিবেশনে তিনি সোজা বলেনঃ

“আমাদের কাছে স্পষ্ট ছিল যে আন্তর্জাতিক বিশ্ববিপ্লবের সাহায্য ছাড়া, প্রলেতারীয় বিপ্লবের বিজয় অসম্ভব। বিপ্লবের আগে, এবং বিপ্লবের পরেও, আমরা মনে করেছিলাম বিপ্লব তাৎক্ষণিকভাবে বা অন্তত খুব অল্পদিনের মধ্যেই ঘটবে অন্য অনগ্রসর দেশে এবং অনেক উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে। অন্যথায় আমরা ধংসের দিকে যাব। এই বিশ্বাস সত্ত্বেও, আমরা যে কোনো পরিস্থিতিতে, যে কোনো মূল্যে সোভিয়েত ব্যবস্থাকে বাচিয়ে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম, কারণ আমরা জানতাম, আমরা কেবল নিজেদের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক বিপ্লবের জন্যও কাজ করছিলাম।”[26]

 সুতরাং, প্রথমত, বিপ্লবী মার্ক্সবাদী দিশা বলেনি যে শ্রমিক শ্রেণী ক্ষমতা দখল করার সঙ্গে সঙ্গে সাম্যবাদের উচ্চতম স্তর আসবে। উত্তরণ, সাম্যবাদের নিম্নতর স্তর, এবং সাম্যবাদের উচ্চতর স্তর, মার্ক্স এই তিনটি স্তরের কথা মনে করেছিলেন। লেনিন ও তার কমরেডরাও মনে করেন নি যে ক্ষমতা দখল করেই রাশিয়ার মতো অনুন্নত দেশে শ্রমিক শ্রেণী সমাজতন্ত্র গড়বে।

সোভিয়েত রাজ কায়েম হয়েছিল একটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে। ১৯১৭-র অক্টোবরের মধ্যে দেশে মোট ৫৫০০ মতো রেল ইঞ্জিন সারানো আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। এই ৫৫০০ হল গোটা রাশিয়ার মোট ইঞ্জিনের ৩০ শতাংশ। ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতি নিছক মালিকের নাশকতামূলক কাজের ফল ছিল না। অনুন্নত অর্থনীতির উপর মহাযুদ্ধের ধাক্কা এর এক বড় কারণ ছিল। এর ফলে, অর্থনীতিকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোই একটা কঠিন কাজ ছিল। ইতিহাসবিদ ই এইচ কার মন্তব্য করেছেন, একদিকে অবশ্যই শ্রমিকদের মধ্যে বিপ্লবের ফলে উৎসাহ এসেছিল, যে অর্থনীতি এবার তাদের স্বার্থে চলবে, অন্যদিকে কিন্তু বলশেভিক নেতারা কেউ মনে করেন নি যে অতি দ্রুত এক রাষ্টায়ত্ত্ব অর্থনীতি গড়ে সেখান থেকে সমাজতন্ত্রের দিকে চলে যাওয়া সম্ভব হবে।[27] যে ট্রটস্কী সবার আগে, ১৯০৫ থেকে বলে আসছেন যে শ্রমিক প্রাধান্য, প্রলেতারীয় ডিক্টেটরশীপ ছাড়া রুশ বিপ্লব সফল হতে পারে না, তিনিও ১৯১৭তে মনে করেছিলেন, একটি মিশ্র অর্থনীতি গড়তে হবে । মার্কিণ অধ্যাপক এডওয়ার্ড রস ১৯১৭-র ডিসেম্বরে ট্রটস্কীকে প্রশ্ন করেন, বলশেভিকরা সব শিল্প জাতীয়করণ করবেন কি না। ট্রটস্কী উত্তরে বলেন, “না, আমরা এখনও সব শিল্প অধিগ্রহণ করতে প্রস্তুত না। তার সময় আসবে, কিন্তু সেটা কবে, তা কেউ এখনই বলতে পারে না। এই মুহূর্তে আমরা আশা করি, একটা ফ্যাক্টরীর আয় থেকে তার মালিক পাঁচ বা ছয় শতাংশ মুনাফা করতে পারবে। আমাদের এখন লক্ষ্য নিয়ন্ত্রণ, মালিকানা না।” তিনি রসকে আরো বলেন, মালিকদের দেশ থেকে পুঁজি অন্যত্র নিয়ে যেতে দেওয়া হবে না, এবং তাদের মুনাফার একটা ভাগ নতুন করে বিনিয়োগ করতে বাধ্য করা হবে।[28]

প্রাথমিকভাবে তাই সভনারকম ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি সীমিত জাতীয়করণের পথে হেটেছিল। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করা হয়। ১৯১৮-র মার্চ অবধি মোটামুটি ৮৫০টি কেন্দ্রীয় স্তরের জাতীয়করণ ঘোষিত হয়, যার মিধ্যে ছিল কিছু একচেটিয়া ক্ষেত্র, কিছু খনি অঞ্চল, কিছু নির্দিষ্ট শিল্প, ইত্যাদি। তলা থেকে জাতীয়করণের প্রবণতা বেশি ছিল, কিন্তু ১৯১৮-র গোড়া থেকে লেনিন জোর দিতে থাকেন পুজিপতিদের সঙ্গে রফার উপর। এর ফলে পার্টিতে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। বামপন্থী কমিউনিস্ট উপদলের জন্ম হয় অংশত ব্রেস্ট লিটভস্ক চুক্তির বিরোধিতা থেকে, আর অংশত অর্থনীতি নিয়ে মতভেদ থেকে। বাম কমিউনিস্ট নেতা ভ্যালেরিয়ান ওবোলেনস্কি (ওসিনস্কি ছদ্মনামে বেশি পরিচিত) ডাক দিয়েছিলেন ব্যক্তি মালিকানার অবসান ঘটিয়ে সাম্যবাদের দিকে উত্তরণের। বাম কমিউনিস্টদের দিকেও অবশ্য সচেতনতা ছিল যে ১৯১৭ অবধি পার্টি অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কোনো সার্বিক দিশার কথা ভাবে নি।[29] তবে বাম কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক ভিত্তি যে দলিল, তাতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ‘দেশপ্রেমিক’ পুঁজির সঙ্গে রফা করে বা জমি ছেড়ে বিপ্লবের অগ্রগতি সম্ভব নয়। সে হবেপিছু হঠা, প্রলেতারীয় গণতন্ত্র ও আন্তর্জাতিকতাবাদের পথ ছাড়া, এবং ের বিপরীতে দরকার সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিতে অর্থনীতির সংগঠন এবং প্রলেতারিয়েতের শক্তিবৃদ্ধি।[30]

লেনিন ও ট্রটস্কী এর উত্তরে বলেন, শ্রমিকদের সরাসরি বিরাট শিল্প চালানোর অভিজ্ঞতা নেই। তাই ধনিক শ্রেণীর সংগঠকদের কাছ থেকে শিখতে হবে। পার্টির মস্কো কমিটির এক সম্মেলনে ২৮শে মার্চ বক্তৃতা দিতে গিয়ে ট্রটস্কী বলেনঃ

“গণতন্ত্রীকরণ আদৌ দক্ষ শক্তির, বিশেষ জ্ঞান সম্পন্ন মানুষের গুরুত্ব অস্বীকার করে না। … তা কেবল যেখানেই সম্ভব তদারকীর সংগঠন হিসেবে তাদের জায়গায় আনবে নির্বাচিত বোর্ডদের। একটি নির্বাচিত বোর্ড, যাতে আছে শ্রমিক শ্রেনীর সেরা প্রতিনিধিরা, কিন্তু যার প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত জ্ঞান যথেষ্ট নেই, তা সেই একজন দক্ষ প্রযুক্তিবিদের জায়গা নিতে পারে না, যে একটি বিশেষ বিদ্যায়তন থেকে পাশ করেছে এবং একটি নির্দিষ্ট কাজ করতে জানে। এই যে কলেজিয়েট নীতির বন্যা, যা আজ সবক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, সেটা এক তরুণ বিপ্লবী শ্রেণীর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। তারা গতকালও নীপিরিত ছিল। তারা তাদের গতকালকের প্রভু, তাদের মালিক ও সমরনেতাদের এক-ব্যক্তির প্রশাসনিক ব্যবস্থার জোয়াল ছুঁড়ে ফেলছে, এবং সব জায়গাতে নিজেদের নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়োগ করছে। আমি বলছি, এটা একটা স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর বিপ্লবী প্রতিক্রিয়া। কিন্তু এটা প্রলেতারিয়েতের অর্থনৈতিক সংগঠনের শেষ কথা নয়।  পরবর্তী পদক্ষেপ হতে হবে শ্রমিক শ্রেনীর নিজের ক্ষমতাকে সীমারেখার মধ্যে আনা, কলেজিয়েট নীতিকে সীমাবদ্ধ করা… । শ্রমিক শ্রেনী জানে, কোন ক্ষেত্রে নির্ণায়ক কথা বলবেন শ্রমিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আর কোন ক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ, বিশেষজ্ঞকে জমি ছাড়তে হবে। তার উপর অনেকটা দায়িত্ব দিতে হবে, কিন্তু তাকে সব সময়ে সচেতন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।”[31]

লেনিন বলেন, নিছক বাজেয়াপ্ত করা আর সামাজিকীকরণের মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রথমটা শক্তি ও মানসিক দৃঢ়তা থাকলেই করা যায়। দ্বিতীয়টার জন্য দরকার লাখে লাখে মানুষের জন্য কাজ করবে এমন বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সংগঠন করার দক্ষতা, যেটার জন্য হিসেব করা, বন্টন যথাযথভাবে করা, এ সব শেখা আবশ্যক। তিনি আরও বলেন, জার্মানীতে সমাজতন্ত্র গঠনের মত বড় পুঁজিভিত্তিক শিল্পায়ন হলেও, রাশিয়াতে তখন পেটিবুর্জোয়া ধনতন্ত্রই বেশি। তিনি মনে করেছিলেন, বড় মাপের রাষ্ট্রীয় পুজিবাদ গড়ে উঠলে তবেই সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়া যাবে।[32]

বামপন্থী কমিউনিস্টরা, এবং বহু শ্রমিক, লেনিন বা ট্রটস্কীর এই মত মানতে রাজি ছিলেন না। তাই ১৯১৮-র জুন অবধি জাতীয়করণের বড় অংশ তলা থেকে হয়েছিল। কিন্তু লেনিন যখন কন্ট্রোল কথাটা ব্যবহার করেছিলেন, তিনি ১৯১৭-র এপ্রিল থেকেই মনে করেছিলেন, মালিকানা থাকবে বুর্জোয়াদের হাতে, কিন্তু তার উপর তদারকী ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকবে শ্রমিকদের এবং শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রের। কিন্তু লেনিনের সামনে একমাত্র সমস্যা এই ছিল না, যে শ্রমিকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এই অর্থনৈতিক দ্বৈত ক্ষমতা চাইছিলেন না। বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যেও এ নিয়ে বড় রকমের দ্বিধা ছিল। পুঁজিপতিদের একটা অংশ জেনারাল কর্নিলভের চক্রান্তের সময় থেকেই সরাসরি প্রতিবিপ্লবের পক্ষে ছিল। অন্যদিকে পল লে ব্ল্যাঙ্ক এবং লারস লি এই পর্বের লেনিনের উদ্ধৃতি দিয়ে দেখচ্ছেন, লেনিন পুঁজিপতিদের সঙ্গে সহযোগিতাকে সবসময়েই সাময়িক মনে করেছেন। ফলে পুঁজিপতিদের মধ্যেও প্রশ্ন ছিল, বলশেভিকদের সঙ্গে রফা করে কোনো লাভ হবে কি না? বলশেভিকদের দিকে, দ্বন্দ্বের সমাধান এখানেই, যে লেনিনরা এই সহযোগিতার পর্ব, এই “মিশ্র অর্থনীতি” একটা খুবই অল্পকালের ব্যবস্থা মনে করেছিলেন, বিশ্ববিপ্লব ছড়িয়ে পড়লেই যার অবসান হবে। পরের অধ্যায়ে আমরা দেখব, সত্যিই ১৯১৮-১৯২১ পর্বে বিশ্ববিপ্লব ছড়িয়ে পড়েছিল, এবং বলশেভিকরা তার প্রসারের জন্য সক্রিয় ছিলেন।

রাষ্ট্রীয় ধনতন্ত্রঃ--অর্থ, বিতর্ক, সম্ভাবনাঃ

কিন্তু তত্ত্বগতভাবেও, রাষ্ট্রীয় ধনতন্ত্র নিয়ে তর্ক উঠেছিল। এখানে আমার উদ্দেশ্য নয়, পরবর্তীকালে যারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে রাষ্ট্রীয় ধনতন্ত্র বলে সনাক্ত করেছেন, তাদের মতামত আলোচনা করার। কিন্তু লেনিন ও বুখারিন, পার্টির দুই তাত্ত্বিক যারা রাজনীতি ও অর্থনীতির উপর যুগ্ম বিশ্লেষণ করেছিলেন, তাদের মতভেদ ছিল। রাষ্ট্রীয় ধনতন্ত্র বলতে বুখারিন একটি সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, আর লেনিন অন্য দুরকম সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। ফলে এই বিতর্ক ছিল কিছুটা একে অপরকে না বোঝার ফলে বিতর্ক। কিন্তু শুধু এইটুকু বলা অন্যায় হবে। এখানে বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে একটা অংশত অনিবার্য দ্বন্দ্বের দিকেও তাকাতে হয়। এক অ-কমিউনিস্ট গবেষক রবার্ট ভিনসেন্ট ড্যানিয়েলস দাবী করেছেন, ১৯১৭-১৮তে বলশেভিক দলে দুটি উপদলের সহাবস্থান দেখা যায় – ‘লেনিনবাদী’ এবং ‘বামপন্থী’। তিনি বলেন, ‘লেনিনবাদীরা জোর দিয়েছিলেন ‘ক্ষমতা’ আর ‘বিপ্লবী প্রয়োগবাদের’ উপর, আর ‘বামপন্থীরা’ ‘নীতি’ এবং ‘বিপ্লবী আদর্শবাদের’ উপর।  সমস্যা হল, আমরা পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলিতে দেখেছি, নীতি এবং আদর্শবাদ বলশেভিক রাজনীতিতে গোড়া থেকে ছিল। উপরন্তু, ড্যানিয়েলস ের পর নিজে স্বীকার করেছেন, গোটা বলশেভিক দলকেই বামপন্থী বলতে হয়। অতঃপর তিনি আরেক রকম বিভাজন যোগ করেছেন – লেনিনবাদিরা ‘কঠিন’, আর বামপন্থীরা নরম। এতে আবার সমস্যা হয়, কারণ ড্যানিয়েলস ট্রটস্কীকে বামপন্থীদের মধ্যে ফেলেন, এবং গৃহযুদ্ধের সফল নায়ক হিসেব ট্রটস্কী ‘নরম’ হওয়ার সুযোগ পান নি।  ফলে তিনি ‘বাম’ দের আবার দুভাগে ভাগ করেন – ‘অতিবাম’, যারা আবেগের ফলে গণতন্ত্রী [আমার জানা নেই, ওসিনস্কি, স্মির্নভ, সাপ্রোনভরা এই তকমা ভালো চোখে দেখতেন কি না], আর মোলায়েম বাম, যেমন ট্রটস্কী ও তাঁর সমর্থকরা, কারণ তাঁরা প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের পক্ষে ছিলেন।[33] এই গোটা বিশ্লেষণটা দাঁড়িয়ে আছে অবাস্তব বিভাজনের উপরে। এখানে বিনা প্রমাণে ধরা হয়েছে, লেনিন নীতির চেয়ে প্রয়োগবাদে বেশি জোর দিতেন। এখানে অগ্রাহ্য করা হয়েছে এমন এক ঘটনা, যা হল, বামপন্থী কমিউনিস্টরা যে নীতির পক্ষে ছিলেন, তার ফল হত সবরকম সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ধারাবাহিক যুদ্ধ। সেটা বেশি নীতিনিষ্ঠ কি না তা নিয়ে তর্ক হতে পারে, কিন্তু সেটা নরম এবং আবেগতাড়িত, এই কথা বলা কতটা যুক্তিসংগত সেটা ভাবা দরকার।  এই কারণে, আমরা বুখারিন ও লেনিনের তত্ত্বগত তর্ককে তত্ত্বগত তর্ক হিসেবেই দেখব। সমস্যাটা প্রয়োগবাদ বনাম মার্ক্সবাদ নয়, বিংশ শতাব্দীতে মার্ক্সবাদের বিকাশ ঘটানো, এবং রাশিয়ার বাস্তব পরিস্থিতিতে তার প্রয়োগের সমস্যা।  

বুখারিন বলেছিলেন, আর্থপুঁজির শাসনকালে রাজনীতি ও অর্থনীতির এক মেলবন্ধন ঘটে।  তিনি একেই বলেন রাষ্ট্রীয় ধনতন্ত্র, এবং তার শীর্ষে থাকে রাষ্ট্রীয় পুজিবাদি ট্রাস্টরা। যারা হল একচেটিয়া পুঁজির সংগঠন, যোউথ প্রতিষ্ঠান, এবং শিল্পের মধ্যে ব্যাঙ্কদের অনুপ্রবেশ। বুর্জোয়া শ্রেণীর অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংগঠন্দের মধ্যে মিলন, যেটা আগের যুগের থেকে আলাদা, কারণ আগে বহু পুঁজির দ্বন্দ্বের জন্য রাষ্ট্রকে আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র রাখতে হত, তাকে বুখারিন সনাক্ত করেছেন পুঁজির জগত জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতার ভিত্তি হিসেবে। এই প্রবণতা হল আজকের যুগে যাকে বলা হয়েছে বিশ্বায়ন, তার পূর্বসূরী। এই পর্বে পণ্যের বাজার আর জাতীয় বাজার থাকে না, রূপান্তরিত হয় বিশ্ব বাজারে। উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্র পরিণত হয় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রে।[34]

বুখারিন বলেন, অর্থনীতি ও রাজনীতির এই সম্পূর্ণ একীকরণ শ্রমিক আন্দোলনের উপরেও প্রভাব ফেলেছিল। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের ব্যাপক অংশ যে মহাযুদ্ধে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের জোয়ারে ভেসে গেল, তিনি বলেন, সেটা ব্যক্ত হল তারা বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সেবাতে নেমেছে বলে। তিনি বলেন, কার্যত তারা বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সমরযন্ত্রের শ্রমিক দপ্তরে রূপান্তরিত হয়েছে। এই রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের দ্বান্দ্বিক বিকল্প হল, তার মতে, প্রলেতারীয় শাসন, যেখানে সোভিয়েত, ট্রেড ইউনিয়ন, বিপ্লবী দল, ফ্যাক্টরী কমিটি, সকলে মিলে সমাজতন্ত্র গড়বে।[35]

লেনিন রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের এক ভিন্ন সংজ্ঞা দিলেন। কার্যত, তিনি দুরকমভাবে কথাটা ব্যবহার করেছিলেন। একটা হল, পুঁজিবাদী মালিকানা থাকবে, কিন্তু তার উপরে রাষ্ট্রের তদারকী থাকবে, এই ধারণা। অন্য ধারণাটা হল, সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ একটি আবশ্যক ধাপ। সমস্ত মানুষের, কোটি কোটি মানুষের প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন ছিল, লেনিনের মতে, কঠোরতম হিসেব, কেন্দ্রীকরণ। এ তখনও সমাজতন্ত্র নয়, কিন্তু তার দিকে পদক্ষেপস্বরূপ রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ।[36] বুখারিন ও অন্য বামপন্থী কমিউনিস্টরা উতপাদন ব্যবস্থায় শৃংখলা এবং মালিকদের সঙ্গে রফাকে সমালোচনা করলে লেনিন বলেন, তারা পেটি বুর্জোয়া মানসিকতায় ভুগছেন, এবং রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ এলে তবেই সমাজতন্ত্রের দিকে এগোনো যাবে। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে সাম্যবাদের জন্য যে উৎপাদিকা শক্তির প্রয়োজন, রাশিয়াতে সেটা নেই, এবং শৃংখলা ছাড়া সেটা আসবে না।[37]

লেনিন সম্ভবত বুখারিন ও অন্য বামপন্থী কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে সঠিক ছিলেন, যে শৃংখলা ছাড়া, একরকম কেন্দ্রীকরণ ছাড়া, গোটা দেশের জন্য যথাযথভাবে উতপাদন করা  যেত না। কিন্তু বুখারিন বা অন্য বামপন্থীরা যে প্রশ্ন তুলেছিলেন, যে সন্দেহ করেছিলেন, সেটাও অমূলক না। ব্যাপক শ্রমিক ও কৃষকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কীভাবে ‘সঠিক’ নীতি আরোপিত হতে পারে? যদি তেমন কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়, তারা কীভাবে ওই ব্যাপক মানুষের চাহিদা বুঝবে? ১৯১৮ শেষ হওয়ার আগেই, লেনিনের মিশ্র অর্থনীতি ধাঁচের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ উঠে গেল। থেকে গেল কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ, যদিও রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ নামটা আর থাকল না। কিন্তু তার সমস্যাগুলি থেকে গেল, এবং পরবর্তীকালে বাড়তে থাকল।

লেনিন যেহেতু এক সময়ে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ কথাটা ব্যবহার করেছিলেন, তাই একেই ধনতন্ত্রের একটা রূপ হিসেবে দেখতে চেয়েছেন কেউ কেউ, যথা টোনি ক্লিফ এবং ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট আন্তর্জাতিক ধারার সদস্যরা। বর্তমান  রচনায় এর তত্ত্বগত আলোচনা করা সম্ভব না। তবে পরে আমরা দেখব, স্তালিন যুগে যে আমলাতান্ত্রিক অর্থনীতি, সেখানে বহু পুঁজির দ্বন্দ্ব ছিল না, এবং মূল্যের সূত্রের আংশিক নেতি ঘটেছিল, তাই তাকে ধনতন্ত্র বলা যায় না।  

ধনতন্ত্র থেকে উত্তরণঃ প্রাথমিক চেষ্টা

১৯১৮ সালে লেনিনদের সামনে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। পারী কমিউন একটা গোটা দেশে শ্রমিক শ্রেণীর শাসন ছিল না, ছিল একতা শহরে অল্পদিনের ক্ষমতার অভিজ্ঞতা। একটা গোটা অর্থনীতির অর্ধেক চলবে পুঁজি সঞ্চয়ের যুক্তিতে, আর অর্ধেক তার নেতির অভিমুখে, এইরকম কোনো পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। কিন্তু একটি দেশের মধ্যে এর কোনো সমাধানও সম্ভব ছিল না। “মিশ্র অর্থনীতি” কয়েকমাসের মধ্যে ভেসে গেল। কিন্তু তার বদলে এল যে তথাকথিত যুদ্ধ(ভিত্তিক) সাম্যবাদ (ভাইনেই  – যার অনুবাদ হতে পারে যুদ্ধকালীন, যুদ্ধভিত্তিক, বা সামরিক ), তাও সমস্যার সমাধান করতে পারে নি।

মিশ্র অর্থনীতি গড়ার প্রচেষ্টা তিনটি কারণে ভেঙ্গে পড়ল। প্রথমত, ধনিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে ১৯১৭ জুড়ে শ্রমিকদের যে লড়াকু চেতনা গড়ে উঠেছিল, তার সবসময়ে তলা থেকে এবং উপর থেকে, একত্রে দুভাবে দেখার দক্ষতা ছিল না। ফলে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ কথাটার অর্থ নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। দ্বিতীয়ত, গৃহযুদ্ধ এবং সাম্রাজ্যবাদী গ্রাসন সংকটা বাড়িয়ে তুলল। তৃতীয়ত, রুশ বুর্জোয়া শ্রেণী দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল, তারা বিপ্লবী সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা নয়, সাবোতাজ করবে, পুঁজি সরিয়ে নেবে, বা স্রেফ পালিয়ে যাবে।     

শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ কথাটার রুশ ভাষায় খুব স্পষ্ট এক, অখন্ড অর্থ ছিল না। ১৯৭৮ সালে উইলিয়ম রোসেনবার্গের একটি প্রবন্ধে মরিস ব্রিন্টন ও ক্রিস গুডির বিতর্ক ও পর্যালোচনা থেকে, বা স্টিফেন কোহেনের লেখা বুখারিনের জীবনী থেকে, আমরা দেখতে পাই, রাবোচেগো কন্ট্রোলিয়া বলতে কি বোঝাবে, এবং ইংরেজিতে সেটা অনুবাদের সমস্যা, দেখে নেওয়া জরুরী। রুশ ভাষায় kontrol, এবং ইংরেজিতে control, পুরোপুরি এক অর্থ বহন করে না। রুশ ভাষায় কথাটা বোঝায়, মালিকানা বুর্জোয়ার, কিন্তু তদারকী অনেকটা শ্রমিকরা করবেন। ইংরেজিতে মালিকের অধিকারের উপরে থাবা বসানোর অর্থ অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, সোভিয়েতরা  ক্ষমতা দখল করার পরে কন্ট্রোল কীভাবে হবে, কে করবে, সেটা নিয়ে অনেক বেশি জটিলতা দেখা দিল। রোসেনবার্গের প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে, ১৯১৮-র গোড়ায় অনেকগুলি সংস্থা শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণের জন্য ফ্যাক্টরী কমিটিদের সমন্বয়সাধনের চেষ্টা করছিল। কেবল পেত্রোগ্রাদ শহরে কেন্দ্রীয় পরিষদ সহ ছ’টি শহর জোড়া সংস্থা ছিল, আর ছিল অন্তত শহরের বিভিন্ন জেলার বারোটি জেলাভিত্তিক সংস্থা।  অক্টোবরের পরে, কোনো কোনো সংস্থা সীমিত নিয়ন্ত্রণের পক্ষে ছিল, কিন্তু কোনো কোনোটি শ্রমিকদের সর্বাত্মক প্রহাসনের দিকে যেতে চেয়েছিল। এদের প্রায় সবকটিতেই প্রাধান্য ছিল বলশেভিকদের।[38] বলশেভিকদের উপর থেকে বসানো নীতি বনাম প্রকৃত শ্রমিকদের তলা থেকে গণতন্ত্র, এই বৈপরীত্য দিয়ে দেখাতে চাওয়া, যেমন চেয়েছেন মরিস ব্রিন্টন, পরেশ চট্টোপাধ্যায় ও অন্যরা, এই কারণে অবাস্তব। এরা ধরে নিয়েছেন, স্তালিন যুগে যে একশিলা বলশেভিক পার্টির মিথ্যা ইতিহাস লেখা হত, সেটা সত্যিই ১৯১৭-১৮তেও ছিল।

শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই পর্যায়ে যে টানাপোড়েন, তার মূল কারণ রাজনৈতিক ছিল না, ছিল অর্থনৈতিক। বলশেভিক দল, বা লেনিন কতটা কেন্দ্রিকতার প্রবক্তা, তা নিয়ে মূল দ্বন্দ্ব ছিল না। লেনিন চেয়েছিলেন ব্যাঙ্ক, বড় কিছু শিল্প ইত্যাদির উপরে শ্রমিক রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ। এর মাধ্যমে নিখুঁত হিসেব করে উৎপাদন ও বন্টন করা হবে, এই ছিল তাঁর ইচ্ছা।  তত্ত্বগতভাবে, তিনি মনে করেছিলেন, নীচে ফ্যাক্টরী স্তরে ফ্যাক্টরী কমিটি তদকী করবে, ট্রেড ইউনিয়নরা মজুরি নিয়ে নীতি প্রবর্তনে বড় ভূমিকা নেবে, এবং ধীরে ধীরে ব্যক্তি মালিকানার বদলে আসবে শ্রমিক রাষ্ট্রের মালিকানা, যেখানে ম্যানেজাররা জবাবদিহি করবে সোভিয়েতদের কাছে, এবং সারা রাশিয়া অর্থনৈতিক সংস্থাদের কাছে।

১৯১৮-র বসন্তকালের মধ্যে,   পেত্রোগ্রাদে ৪০টি প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হয়েছিল, ৬১টি সাময়িকভাবে ফ্যাক্টরী কমিটিরা চালাচ্ছিল, ২০৭টি শ্রমিক নিয়ন্ত্রণে চলছিল, আর ৪০২টি পুরোদস্তুর মালিকরাই চালাচ্ছিল। পাকাপাকিভাবে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ চালু হয়েছিল বড় প্রতিষ্ঠানগুলিতে। যে ৪০২টি তখনও পুরো ব্যক্তিমালিকানায়, সেগুলি অধিকাংশই ছোটো প্রতিষ্ঠান। শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ কথাটার অর্থ, ফ্যাক্টরীর মধ্যে পুঁজিপতি ও তার ম্যানেজাররা তখনও ছিল, কিন্তু ফ্যাক্টরী কমিতির সম্মতি ছাড়া তারা একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারত না। ফ্যাক্টরী কমিটি দেখত হিসেবের খাতা, যন্ত্রের অবস্থা, ও আরো  অনেক কিছু। পেত্তযগ্রাদের ফ্যাক্টরী ও কর্মশালার সমিতি নামে মালিকদের একটি সংগঠন সোভিয়েত সরকারের ডিক্রীকে নিন্দা করে, এবং এদের হাবভাব ছিল সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা করা।

মালিকদের মধ্যে একটা অংশ সাময়িকভাবে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু শ্রমিকদের অনেকে কোনোরকম রফা করতে রাজি ছিলেন না। বলশেভিকদের মধ্যেও এই মত যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। ইতিহাসবিদ স্মিথ তার লাল পেত্রোগ্রাদের উপর গ্রন্থে দেখিয়েছেন, বামপন্থী কমিউনিস্টরা বলেছিলেন, শ্রমিক-কৃষক ডিক্টেটরশিপ যদি খনি ও ফ্যাক্টরীতে শোষণের অবসান না করে তবে তা হবে সাময়িক। আর, লড়াইতা পার্টির দুটো উপুলের মধ্যে ছিল না। জতীয়করণ প্রধানত হচ্ছিল তলা থেকে, ফ্যাক্টরী কমিটিদের উদ্যোগে, উপর থেকে অর্থাৎ সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক পরিষদ বা ভেসেঙ্কার উদ্যোগে নয়।[39]

লেনিন ও তার সমর্থকরা এই প্রক্রিয়াকে বাধা দিতে চাইলেন। সাংবাদিক উইলিয়ম হেনরী চেম্বারলিন রুশ বিপ্লবের যে তথ্যবহুল ইতিহাস রচনা করেছিলেন, তাতে তিনি দেখান, শ্রমিকদের প্রতিনিধিরা লেনিনের কাছে এসে বিভিন্ন ফ্যাক্টরী জাতিয়করণের দাবী তুললে লেনিন প্রশ্ন করতেন, তারা জানেন কি না, ওই ফ্যাক্টরীতে কি কি উতপাদন হয়, তার বাজার কোথায়, এবং ফ্যাক্টরী তাদের হাতে গেলে তারা সেটা কিভাবে দক্ষ পরিচালনার কথা ভাবছেন। এর সন্তোষজনক উত্তর না পেলে লেনিন প্রস্তাব করতেন, তারা মালিক ও ম্যানেজারদের সঙ্গে আলোচনা করে রফা করুন।[40]

কিন্তু যুদ্ধের ফলে রাশিয়ার অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েছিল, যা আমরা আগেই দেখেছি। ফলে শ্রমিকদের মধ্যে  অসন্তোষ বাড়তে থাকে। ফলে একদিকে বিপ্লবের প্রথম দিকে সোভিয়েত সরকার সাবধানে পশ্চিম ইউরোপের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছিলেন, কোনোরকম সাহায্য, বিনিয়োগ সম্ভব কি না, আর অন্যদিকে তলা থেকে ফ্যাক্টরী জাতীয়করণ হতে থাকে। ক্রিস গুডির ভাষায় এ ছিল ‘ও্যাইল্ডক্যাট জাতীয়করণ’। তিনি দেখিয়েছেন, এর ফলে পাশ্চাত্যের প্রতিনিধিরা প্রকৃয় কোনো আলোচনায় যেতে রাজি হলেন না। শুধুতাই নয়, গুডি মনে করেন এর ফলেই বহু পুঁজিবাদি দেশ রাশিয়া আগ্রাসন করল, গৃহযুদ্ধ পুরোদমে আরম্ভ হল, এবং ১৯২০-র মধ্যে অর্থনীতি ধ্বসে গিয়ে পুরোনো শ্রমিক শ্রেণীর কার্যত  বিলোপ হল।[41]

ধনিক শ্রেণীর বড় অংশ ক্রমে এই সংকট বাড়ানোরই চেষ্টা করল। ব্রেস্ত-লিটভস্ক চুক্তির আগে জার্মানদের আগ্রাসন, এবং চুক্তির পরে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসন, রুশ দক্ষিণপন্থীদের নিজস্ব ফৌজী বিকল্প গড়া সম্ভব করে তুলল। জেনারাল কর্নিলভ, এবং তারপর অ্যাডমিরাল কলচাক, জেনারাল দেনিকিন, ইয়ুদেনিচ, এবং ব্যারন র‍্যাঙ্গেলের নেতৃত্বে ১৯১৮-১৯২০  ধরে এক তীব্র গৃহযুদ্ধ চলে, যার লক্ষ্য ছিল শ্রমিক শাসন খতম করে উগ্র দক্ষিণপন্থী বুর্জোয়া-জমিদার শাসন আনা। যখন ১৯১৮-র জুন মাসে বোঝা গেল আঁতাত শক্তিবর্গ বন্দুকের নলে রুশ বিপ্লবকে খতম করতে চায়, তখন সার্বিক জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত হল, যত না সমাজতন্ত্র গড়ার লক্ষ্য, তার চেয়ে বেশি যুদ্ধের সময়ে অর্থনীতিকে রাষ্ট্রের হাতে রাখার জন্য। সরকারের চিন্তা ছিল, মালিকরা শেতরক্ষী বাহিনীর (দক্ষিণপন্থীদের) সুবিধা করার জন্য সাবোতাজ করতে পারে, তাই কম দক্ষ হলেও, বিপ্লবের প্রতি অনুগত মানুষের হাতে পরিচালনা ন্যস্ত থাকতে হবে।[42]

যত জরুরী হোক না কেন, “যুদ্ধ সাম্যবাদের” দিকে এই যাত্রা গভীর সংকট তৈরী করল।. এর ফলে অর্থনৈতিক সংকট বাড়ল। শুধু তাই না, বাস্তবে এর ফলে শ্রমিক শ্রেণীর ক্ষমতা কমল। জুন থেকে সেপ্টেমবরের মধ্যে ব্যাপকভাবে জাতীয়করণ বাড়তে থাকল। ভিক্টর সার্জ, যিনি নৈরাষ্ট্রবাদী অবস্থান থেকে বলশেভিকদের সঙ্গে গিয়েছিলেন, তার বইয়ে লেখেন,  শিল্প জাতীয়করণের ফলে রাষ্ট্রের উপর ক্রমেই বেশি বেশি মানুষের দেখভালের সরাসরি দায়িত্ব এসে পড়ল। রাষ্ট্র বাধ্য হল প্রশাসনের জন্য বহু লোককে টেনে আনতে, যাদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ সরাসরি শ্রমিকদের মধ্য থেকে আসে নি। এই ভাবে সূচনা হল এক আমলাতন্ত্রের। ১৯১৮ থেকে ১৯১৯-র মধ্যে প্রশাসনিক কর্মচারির সংখ্যা ১১৪,৫৩৯ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৫২৯,৮৪১-এ। ১৯১৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যা ছিল ২৫১,০০০ (মনে রাখতে হবে, এই সময়ে ইউক্রেন, ট্রান্স-ককেশিয়া, ও বালটিক সাধারণতন্ত্রগুলি স্বাধীন, ফলে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য মানে শুধু রাশিয়ার পার্টির সদস্য)। সার্জ জানান, এই হঠাত গজিয়ে ওঠা আমলারা পার্টিতেও ঢুকতে শুরু করে।[43]

অর্থনৈতিক সংকট কতটা ভয়ানক হল, তার পূর্ণাংগ ছবি অনেক দীর্ঘ হবে। সামান্য কিছু তথ্য এখানে দেওয়া আবশ্যক।

সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক পরিষদের বলশেভিক সভাপতি, পরে (১৯২০-র দশকে) বুখারিনের প্রধান মিত্র, আলেক্সেই রাইকভবলেন, ১৯১৮ থেকে ১৯১৯-এর মধ্যে জাতীয়করণের সংখ্যা ১১২৫ থেকে বেড়ে মোটামুটি ৪০০০-এ উঠেছিল। এই ছিল রাশিয়ার শিল্পের ধিকাংশ। কিন্তু ১৯২০-র গোড়ায় এদের প্রায় অর্ধেক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।[44] ভিক্টর সার্জ লিখেছেন, শ্রমিক শ্রেণী ক্লান্তির সবরকম লক্ষণ দেখাছহিলেন.১৯১৮-র শেষদিকে একজন শ্রমিকের আয়ের প্রায় ৭০% চলে যাচ্ছিল শুধু কাবার কিনতে। তিনি আরো বলেন, সবচেয়ে জঙ্গী, রাজনীতি সচেতন শ্রমিকদের এক বড় অংশ অনেকেই যুদ্ধে বা সোভিয়েত রতিষ্ঠানের কাজে ফ্যাক্টরী ছেড়ে গিয়েছিলেন। ফ্যাক্টরী থেকে চুরি বাড়ে। অনেক শ্রমিক গ্রামে, কৃষকদের মধ্যে ফিরে যান, কারণ সেখানেই তাদের যোগাযোগ ছিল।[45]

পল লে ব্ল্যাঙ্ক বিভিন্ন তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন, উৎপাদন ১৯১৩-র তুলনায় ১৯১৮তে কতটা কমেছিল।[46]

 মিলিয়ন (১০ লাখ) পুদের হিসেবে উৎপাদন (১ পুদ= ১৬.৩৮ কিলোগ্রাম)

 

১৯১৩

১৯১৮

কয়লা

১৭৩৮

৭৩১

আকরিক লোহা

 ৫৭৮৮৭

১৬৮৬

ঢালাই লোহা

২৫৬

৩১.৫

ইস্পাত

২৫৯

২৪.৫

রেল

৩৯.৪

১.১

মস্কোতে মৃত্যুর হার বাড়ে, ১৯১৩তে প্রতি হাজারে ২৩.১ থেকে ১৯১৯-এ প্রতি হাজারে ৪৫.৪ অবধি। দেশের পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে।

এই পরিস্থিতিতে সরকার ও বলশেভিক দলের সম্ভবত কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো বিকল্প ছিল না। গৃহযুদ্ধের ফলে সেটা আরো বাড়ল। কিন্তু সমস্যা হল, কারণ অনেক সময়েই, এটা যে বিপদে পড়ে সাময়িক পদক্ষেপ, সে কথা না বলে একেই শ্রমিক শ্রেণীর ডিক্টেটরশিপ এবং সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রগতি বলে দেখানো হল। পরবর্তী কোনো অধ্যায়ে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা জরুরী।



[1] Sidney Hook, ‘Bolshevik Coup Lacked Popular Support’, New York Times, August 20, 1988.

[3] Ibid.

[5] Rosa Luxemburg, ‘ Nationalversammlung oder Räteregierung?, in Rosa Luxemburg, Gesammelte Werke, Bd.IV, Dietz Verlag, Berlin 1990, pp. 460-463, esp. p. 463.

 

[6] Rosa Luxemburg, ‘Die Wahlen zur Nationalversammlung’, in Rosa Luxemburg, Gesammelte Werke, Bd.IV, pp. 472-474. See especially p. 474.

[7] Paul Le Blanc, October Song, Haymarket Books, Chicago, 2017, p.112.

[8] E. Cinella, ‘The tragedy of the Russian Revolution: promise and default of the Left Socialist Revolutionaries in 1918’, Cahiers du Monde russe,xxxviii, 1997, pp.45–82; M. Melancon, ‘The Left SRs and the Bolshevik uprising’, in The Bolsheviks in Russian Society: the Revolution and Civil War, ed. V. N. Brovkin, Yale University Press, New Haven, Conn., 1997, pp. 59-88.

[9] J. LLh. H. Keep, ed., The Debate on Soviet Power, Oxford, Clarendon Press, 1979, p. 130.

[11] J. LLh. H. Keep, ed., The Debate on Soviet Power, pp. 149, 201, 373-375.

[12] Partiiya levykh: Partii͡a︡ levykh sot͡s︡ialistov-revoli͡u︡t͡s︡ionerov: Dokumenty i materialy : 1917-1925 gg, Rosspen, 2000, pp.334-344, 349.

[16] Paul Le Blanc, October Song, p.122.

[17] O. H. Radkey, The Elections to the Russian Constituent Assembly of 1917, Harvard University Press, Cambridge, Mass., 1950.

[18] Roy Medvedev, The October Revolution, Constable, London, 1979, p.108.

[19] Alfred G. Meyer, Leninism, New York, Frederick A. Praeger, 1962, p. 193.

[23] উদাহরণ স্বরূপ, Charles Bettelheim, John N. Westwood (Translator), Class Struggles in the USSR, Third Period: 1930 1941, The Dominated, T R. Publications, Madras 1994. এর ভূমিকাতে বেতেলহাইম বলে দিয়েছেন, অক্টোবর ১৯১৭ থেকেই এই বিপ্লব ছিল পুঁজিবাদী বিপ্লব।

[24]  V. I.   Lenin, ‘The Stages, the Trend, and the Prospects of the Revolution’ https://www.marxists.org/archive/lenin/works/1905/dec/31.htm

[25]VI Lenin, ‘The Valuable Admissions Of Pitirim Sorokin’, https://www.marxists.org/archive/lenin/works/1918/nov/20.htm

[26] V.I.Lenin, ‘Report on the Tactics of the R.C.P.’, https://www.marxists.org/archive/lenin/works/1921/jun/12.htm

[27] E. H. Carr, The Bolshevik Revolution, vol. 2, The MacMillan Company, New York, 1952, pp. 69, 81.

[28] E. A. Ross, Russia in Upheaval, The Century, New York, pp. 208, 212.

[29] N. Osinskii, Stroitel'stvo sotsializma, Moscow, p. 34.

[30] R.V. Daniels, A Documentary History of Communism, vol. 1, New York, Vintage Books, 1962, pp. 152, 154, 155.

[31] Leon Trotsky, Work, Discipline, Order’,Report to the Moscow City Conference of the Russian, Communist Party, March 28, 1918, https://www.marxists.org/archive/trotsky/1918/military/ch05.htm

[32] V. I. Lenin., Collected Works, 4th English Edition, Progress Publishers, Moscow, 1972 Volume 27, pages 323-334. For online text see  https://www.marxists.org/archive/lenin/works/1918/may/09.htm

[33] R. V. Daniels, The Conscience of the Revolution. Communist Opposition in Soviet Russia, Cambridge, Mass., 1960, pp. 4-6

[34] N. Bukharin, The Politics and Economics of the Transition Period, London, Routledge and Kegan Paul, pp. 48, 60, 63, 78.

[35] Ibid., pp. 79, 96, 101, 104, 105, 106.

[36] দ্রঃ, Lars Lih, Bread and Authority in Russia: 1914-1921, Berkeley, University of California Press, 1990, pp. 149-51.  

[37] LCW, vol. 27, pp. 293, 294, 297, 300, 301, 303-4, 305.

[38] William Rosenberg, Workers and Workers’ Control in the Russian Revolution, History Workshop, Spring, 1978, No. 5, pp. 90-92.

[39] S.A. Smith, Red Petrograd, Cambridge, Cambridge University Press, 1986, pp. 224, 229, 230, 239.

[40] W. H. Chamberlin, The Russian Revolution, 1917-1921, 2 vols, New York, Grosset & Dunlap, 1965, vol. 1, p. 415.

[41] Chris Goodey, “Factory Committees and the dictatorship of the Proletariat (1918)”, Critique 3, no.1, 1974: pp. 27-47, esp. pp. 42-44.

[42] E. A. Ross, The Russian Soviet Republic, New York, The Century, 1923, pp. 341-2.

[43] Victor Serge, Year One of the Russian Revolution, Chicago, Holt, Rinehart and Winston, pp. 353, 356.

[44] E. A. Ross, The Russian Soviet Republic, pp. 342.

[45] Victor Serge, Year One of the Russian Revolution, pp. 241, 350, 351.

[46] Paul Le Blanc, October Song, p. 158

Comments

Popular posts from this blog

An Open Letter to Tariq Ali

Arguments for Proportional Representation

Remembering Hiroshima, fight nuclear weapons, power and capitalism